সম্পর্ক একটা দার্শনিক ব্যাপার। অনেকটা ধর্মের মতো। ধর্মের ভিত্তি যেমন যেমন বিশ্বাস, সম্পর্কও তাই। বিশ্বাস ব্যাপারটা ধরাছোঁয়ার মতো কিছু নয়। বিশ্বাস একটি ধারণা। অনেক বড় একটি ধারণা। বিশ্বাস হলো আস্থা। এই আস্থা নিজের প্রতি যেমন, তেমনি অন্যের প্রতিও। বিষয়টা অনেকটা কাব্যিক প্রতিভার মতো, ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি।’ তেমনি বিশ্বাসটা, আস্থাটা সকলের ওপর স্থাপন করা যায় না। যিনি আপনজন, যার ওপর নির্দ্বিধায় ভরসা করা যায়, আস্থাটা সেটিই। আস্থাটা তার ওপরই জন্মায়।
জীবন শুরু করতে আস্থা করবার মতো মানুষ চাই। কিন্তু সকলেই কাঙ্ক্ষিত সে মানুষটির খোঁজ পেয়ে যান, সে দাবি করেন না সকলে। যদি সকলে পেয়ে যেতেন তবে সুখি মানুষে চারপাশ ভরে থাকত। কিন্তু বাস্তবতা সেটি নয়। বাস্তবতাটাও কাব্যিক প্রতিভার মতো, ‘সকলেই সুখি নয়, কেউ কেউ সুখি।’ সকলের মাঝে যারা এই ‘কেউ কেউ’, তাঁরাই আসলে সৌভাগ্যবান। আমি খুব বিনয়ের সঙ্গে আপনাদেরকে জানাতে চাই, আমি, মানে আমরা দু’জনে ওই সৌভাগ্যবানদের দলের লোক।
তাকানো ও দেখায় একটা মোটাদাগের পার্থক্য আছে। এও কাব্য প্রতিভার মতো, তাকায় সকলেই, কেউ কেউ দেখে। ঠিক পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমাদের প্রথম দেখাটা আক্ষরিক অর্থেই প্রথম দেখা ছিল। আমরা কেবল পরস্পরের দিকে তাকাই নি। দেখেছিলাম পরস্পরকে। সে দেখায় শুধুই মুগ্ধতা ছিল না। ছিল উপলব্ধি। আবিষ্কার ছিল — হ্যাঁ, এই মানুষটিকেই আমি খুঁজছিলাম। এটি একটি দার্শনিক ব্যাপার। বিশ্বাস এর নাম। অনেকটা ধর্মের মতো। কিছুই না দেখে না শুনে আস্থা রাখা। হ্যাঁ, আস্থা এর নাম। এই বিশ্বাস, আস্থা এ। বড় পবিত্র। তারপর জানতে পারা আমরা সঠিক ছিলাম। আমরা পরস্পরে পরস্পরকেই চাই। ওই সেদিনই, আমাদের প্রথম দেখা, যেদিন, নিঃশব্দে, চুপি চুপি আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, আমরা আমাদের জীবনটাকে একসঙ্গে কাটাতে চাই।
সেটি আজ থেকে ৩৫ বছর আগের কথা।
একসঙ্গে জীবন কাটাতে চাওয়ার সিদ্ধান্তটি জীবনকে স্বাপ্নিক করে তোলে। স্বপ্ন ব্যাপারটি যখন হাতের মুঠোয় ধরা দেয় তখন সে আর স্বপ্ন থাকে না। বাস্তবতার সঙ্গে মিশে যাওয়া স্বাপ্নিক জীবনে যুক্ত জয় কঠিনটা। স্বপ্ন থাকে বটে, সঙ্গে থাকে চড়াই উৎরাইও। আমরা সে চড়াই উৎরাই সঙ্গে নিয়েই পরস্পরে মগ্ন হতে থাকলাম। আমাদের বয়স, চারপাশের পরিবেশ, স্বজন, চলবার পথ— সকলই কোনো না কোনো সময়ে আমাদের বিরোধিতা করেছে। হয়ত আমাদের বিচ্ছিন্নতাও চেয়েছে। কিন্তু আমরা এই এখনকার মতো, এই এতটা সুস্পষ্টভাবে না হলেও আমরা জানতাম, সম্পর্ক একটা দার্শনিক ব্যাপার, অনেকটা ধর্মের মতো। ধর্মের ভিত্তি যেমন যেমন বিশ্বাস, সম্পর্কও তাই। একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ছিল আমাদের। ছিল আস্থা। এ বিশ্বাস, এ আস্থা বড় পবিত্র।
তারপর এই বিশ্বাস ও আস্থায় পেরিয়ে গেল দশটি বছর। দশ বছর বড় কম সময় নয়। অনেক চড়াই উৎরাই ছিল পথে। চলতে কষ্ট হয়েছে। কিন্তু থামি নি আমরা। একে ক্লান্ত হলে অন্যে হাত ধরে পরম মমতায় টেনেছি কাছে। পিছু হটি নি। মাথা নোয়াই নি। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ সিদ্ধান্তটি দশ বছরে আরও দৃঢ় হয়েছে তখন।
তারপর এল আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির সঙ্গের কাঙ্ক্ষিত সেইদিন। আমরা দু’জনে তখন খুব করে মগ্ন দু’জনাতে। সম্পর্কটাকে আমরা বেঁধে ফেললাম একটা দৃশ্যহীন বন্ধনে। আজ থেকে ঠিক ২৫ বছর আগে।
এরপর কেটে গেছে পঁচিশটি বছর। এখন আমরা তিনটি সন্তানের জনক-জননী। আমাদের সুখের অংশ হয়ে বেড়ে উঠছে তারা। আমরা খুব আনন্দ নিয়ে তাদের বেড়ে ওঠা দেখি। এই আনন্দে মিশে থাকে আমাদের সকল মুগ্ধতা আর বিস্ময়। জীবনের পথ তো। সে পথ কোথাও উন্নত, অবনত কোথাও। বন্ধুর। কষ্ট ছিল, অপ্রাপ্তি ছিল অনেক। কিন্তু সুখটা ছিল সবটা জুড়ে। আছে এখনও। কেননা সুখ বলতে আমরা আমাদের পরস্পরকেই বুঝে এসেছি। রহস্যটি হলো, সম্পর্কটা আসলে ধর্মের মতো। বড় পবিত্র। ধর্ম যার বন্দনা করতে নির্দেশ দেয়, সম্পর্কও তাঁরই নির্মাণ।